ZOOM wins the WFH app war. Source: bloomberg |
লেনিন বলেছিলেন - "অনেক দশক যায় যেখানে কিছুই ঘটেনা, আবার এমন সপ্তাহ যায় যেখানে দশক ঘটে যায়"। কথাটি টেলিকনফারেন্সিং এপ্লিকেশন জুম (ZOOM) এর জন্য শতভাগ প্রযোজ্য। করোনাভাইরাস মহামারী অধিকাংশ কোম্পানির জন্য অভিশাপ বয়ে আনলেও, কিছু কোম্পানির জন্য হয়েছে শাপে বর। জুম তাদের মধ্যে একটি।
একটু চিন্তা করে দেখেন, করোনাভাইরাস যদি ২০১১ সালে হানা দিতো, দুনিয়াজোড়া সবাই ধুমসে স্কাইপে (Skype) ভয়েস কল এবং ভিডিও কল করতো। ২০১১র স্কাইপ-এর জায়গাটা ২০২০ এ নিয়ে নিয়েছে জুম এবং হাউজপার্টি (Houseparty)। নতুন দশকের প্রথম বছরের তিন মাস যেতে না যেতে করোনার কারণে যেখানে অফিস ডেস্ককে সরিয়ে জায়গা করে নিয়েছে হোম অফিস, স্কুল-কলেজ-ইউনিভার্সিটির ক্লাসরুম পরিণত হয়েছে ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে, পাবলিক কনফারেন্সগুলো রূপ নিয়েছে টেলিকনফারেন্স বা ওয়েবিনার-এ, সেখানে আমাদের হাতের মোবাইলটিতে বা বাসার কম্পিউটারে যোগ হয়েছে একটি অ্যাপ; জুম।
আবার যাওয়া যাক ২০১১ সালে। ঐ বছরই মাইক্রোসফট ৮.৫ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে কিনে নেয় স্কাইপ-কে। একই বছর আবির্ভাব হয় জুম এবং স্ন্যাপচ্যাট (Snapchat)-এর। ১০০ মিলিয়নের বেশি এক্টিভ ইউজার নিয়ে স্কাইপ-এর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। বলাই বাহুল্য আমাদের অধিকাংশের ইন্টারনেটের মাধ্যমে অডিও ও ভিডিও কলের সাথে হাতখড়িই হয়েছে এই স্কাইপ-এর মাধ্যমে। স্কাইপ এতটাই জনপ্রিয় হয়ে উঠে যে ২০১৪-১৫ সালে অক্সফোর্ড ডিকশনারিতে শব্দ হিসেবে যুক্ত করা হয় স্কাইপ-কে। এই তুমুল জনপ্রিয়তার মধ্যে মাইক্রোসফট বা স্কাইপ যে বেশ কিছু সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছিলো সেটা অনেকেই জানতোনা বা বুঝতে পারেনাই।
প্রথম সমস্যা ছিলো যেটা সব ব্যবসাতেই থাকে, প্রতিযোগিতা; ব্যতিক্রম অবশ্য অ্যামাজন (Amazon), এটার নাম পরিবর্তন করে প্যাকম্যান (Pac-Man) রাখা যায়; It doesn't face competitions, it EATS the COMPETITIONS। যাই হউক, ঐ সময়টাতে হোয়াটসঅ্যাপ, মেসেঞ্জার, স্ন্যাপচ্যাট, উইচ্যাট - এর ব্যবহার বেড়ে চলছিলো সমান তালে, যা স্কাইপ-এর জন্য ছিলো মাথাব্যথার কারণ। তবে স্কাইপ-এর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো এটি মোবাইলে ব্যবহার করতে ইউজাররা ব্যাপক ঝামেলায় পড়তো। সেই সময়টায় মোবাইল ফোনের সহজলভ্যতা এবং মোবাইল ইন্টারনেটের বহুল ব্যবহারের ফলে মানুষের কাছে মোবাইলের উপযোগী এপ্লিকেশনগুলোর গ্রহণযোগ্যতা বাড়তে থাকে। আর এখানেই মার খেয়ে যায় স্কাইপ।
পরবর্তী বিজনেস স্ট্র্যাটেজি ঠিক করতে গিয়ে আবারো পা হড়কায় মাইক্রোসফট। স্কাইপ-কে নিজেদের উইন্ডোজ ফোনের উপযোগী করে তুলতে গিয়ে ফিচারে বেশ কিছু পরিবর্তন আনে সে। এই ট্রানসিশনের পরে স্কাইপ উইন্ডোজ ফোনের উপযোগী হলেও এন্ড্রয়েড ফোনের জন্য অতটা ইউজার ফ্রেন্ডলি ছিলোনা। তাছাড়া এই পুরো ট্রানসিশনে সময়ও অনেক বেশি নিয়ে ফেলে মাইক্রোসফট। এসময় অন্যান্য কম্পিটিটররা বেশ ভালই মার্কেট পেয়ে যায়। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে এবং গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে মাইক্রোসফট বিভিন্ন সময়ে স্কাইপ এর লুক পরিবর্তন করে স্ন্যাপচ্যাট বা মেসেঞ্জার এর মত করার চেষ্টা করে। বলাই বাহুল্য সবগুলো স্ট্র্যাটেজি বা পরিকল্পনা হয় হিতে বিপরীত; উলটো স্কাইপ-এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা দিনের পর দিন কমছিলো।
স্কাইপের স্ন্যাপচ্যাট লুক। Source: idownloadblog.com |
স্কাইপের মেসেঞ্জার লুক। Source: theverge.com |
এর মধ্যেই মাইক্রোসফট তাদের অফিস কমিউনিকেটর লিংক (Lync)-কে পরিবর্তন করে স্কাইপের মাধ্যমে। তাদের করপোরেট ক্লায়েন্টলের কাছে বিজনেস কমিউনিকেটর হিসেবে প্রমোটও করে স্কাইপকে। কিন্তু পরবর্তীতে মাইক্রোসফট নিজেই এই প্রমোশন থেকে সরে আসে এবং তাদেরই আরেকটি প্রোডাক্ট মাইক্রোসফট টিম (Microsoft Team)-কে প্রমোট করা শুরু করে। পরবর্তীতে স্ল্যাক (Slack), ট্রেলো (Trello), ফ্যাভ্রো (Favro) ইত্যাদি বিভিন্ন বিজনেস কমিউনিকেটরের সাথে পাল্লা দিতে গিয়ে মাইক্রোসফট তাদের পুরো ফোকাস "Team"-এর উপর দেয় এবং স্বাভাবিকভাবেই স্কাইপের প্রমোশনের মাত্রাও স্তিমিত হয়ে পড়ে।
এখন জুম কিভাবে জনপ্রিয় হল সেটার দিকে আলোকপাত করা যাক। সহজভাবে বললে মাইক্রোসফট বা স্কাইপ যেটা করতে ব্যর্থ হয়েছিলো সেটাতেই সফল হয় জুম; এবং তা হল "ইউজার ফ্রেন্ডলিনেস"। একই রকম এপ্লিকেশন অনেকগুলো থাকার কারণে আমরা যেটা সহজে এবং হ্যাপা ছাড়া ব্যবহার করা যায় তার দিকেই ঝুঁকি। জুম বা হাউজপার্টি ব্যবহার সবচেয়ে সহজ। জুমের মাধ্যমে কথা বলতে কোন একাউন্ট থাকা লাগেনা; ৪০ মিনিট পর্যন্ত ফ্রিতে ব্যবহার করা যায়। আবার করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউনের সময়ে জুম তার এই ৪০ মিনিটের সময়সীমাও তুলে দেয়। যার ফলে তার ইউজারের সংখ্যাও বাড়তে থাকে হু হু করে।
অবশ্য জুমের চলার পথ যে একেবারে মসৃণ তাও না। এইতো কিছুদিন আগে জুমবম্বিং (Zoombombing)-এর শিকার হয়েছেন কিছু ব্যবহারকারী যেখানে কিছু "বম্বার" বিভিন্ন মিটিংয়ে ঢুকে সেখানে অনাকাঙ্খিত ছবি বা ভিডিও পোস্ট করে দেয়। যদিও মনে হয়না এসব সাময়িক সমস্যা জুমের জন্য কোন বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে বা দাঁড়াবে।
জুম তাদের মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা কখনোই প্রকাশ করেনা; কিন্তু এটুকু জানা গিয়েছে যে, পুরো ২০১৯ সালে যেখানে তাদের ১.৯৯ মিলিয়ন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়েছিলো, এই বছরের ২৬ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত নতুন ব্যবহারকারী যুক্ত হয়েছে ২.২২ মিলিয়ন। মাইক্রোসফট অনেক আগে থেকেই স্কাইপের ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রকাশ করা বন্ধ করে; সর্বশেষ প্রকাশিত সংখ্যা অনুযায়ী মোট ব্যবহারকারী ছিল ২০০ মিলিয়নের কিছু বেশি। ২০২০ এর মার্চের শেষ পর্যন্ত প্লে স্টোরে সর্বোচ্চ ব্যবহৃত অ্যাপের মধ্যে স্কাইপ ছিলো ৭৫ নম্বরে, টিম ৭ নম্বরে এবং জুম ছিলো ১ নম্বরে। মাইক্রোসফটও তাদের বিজনেস স্ট্র্যাটেজিতে তাদের "Team" প্রোডাক্টটিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে বেশি। ২০০ মিলিয়ন ব্যবহারকারীসহ স্কাইপকে পুরোপুরি হাওয়া করে দিলেও অবাক হওয়ার মত কিছু হবেনা (যেটি তারা করেছিল উইন্ডোজ লাইভ মেসেঞ্জারের ক্ষেত্রে)।
Zoom stock price trend. Source: Investing.com |
জুমের ব্যাপারে কিছু তথ্য দিয়ে শেষ করা যাক। করোনাভাইরাস প্যান্ডেমিকের আগে (২৪ ডিসেম্বর, ২০১৯) জুমের শেয়ার মূল্য ছিল $৬৬ যা এই বছর জুনে এসে দাঁড়িয়েছে $২৫৭ তে। মার্কেট ভ্যালুর দিক দিয়ে জুম এখন ৭টা এয়ারলাইন্স কোম্পানির মার্কেট ভ্যালুর সমান। আমরা যেখানে সবাই মনেপ্রাণে চাচ্ছি করোনাভাইরাসের নিধন, জুম "অন্যরকম" কিছু চাইলে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
ZOOM Beats seven airlines combined. Source: visualcapitalist |
Reference:
No comments:
Post a Comment