এই বছরের ২০শে এপ্রিল বিশ্ব বাণিজ্যের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের (Crude Oil) দাম নেমে যায় শূন্যের নিচে, প্রতি ব্যারেলে -৩৭.৬৩ ডলারে। অর্থাৎ নিজেদের মজুদে থাকা প্রতি ব্যারেল তেল সরাতে বিক্রেতারা উল্টো ক্রেতাদেরকে ৩৭.৬ ডলার করে মূল্য দিয়েছেন। এত কম দামে তেল পেয়ে বড় আমদানিকারক দেশগুলোও কিছু সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেছে। পুরো বিষয়টি ব্যাখা করার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।
বিশ্ববাজারে বিভিন্ন গ্রেডের অপরিশোধিত তেল আছে; সবচেয়ে পপুলার দুটি গ্রেড হলো - ব্রেন্ট নর্থ সি ক্রুড অয়েল, সংক্ষেপে ব্রেন্ট ক্রুড(Brent Crude) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড অয়েল, সংক্ষেপে ডব্লিউটিআই ক্রুড (WTI Crude)। উত্তর সাগরের আশেপাশের ক্ষেত্র থেকে ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েল উত্তোলিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার কুশিং (Cushing) এবং তার আশেপাশের বিভিন্ন তেল ক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত হয় ডব্লিউটিআই ক্রুড। আফ্রিকা, ইউরোপ ও মিডল ইস্টের দেশগুলোর তেলের দাম নির্ধারিত হয় ব্রেন্ট ক্রুডের মাধ্যমে এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে হয় ডব্লিউটিআই ক্রুডের মাধ্যমে। কমোডিটি মার্কেটে তেলসহ আরো বেশ কিছু কমোডিটির ফিউচারস(Futures) ট্রেডিং হয় যেখানে কোন মাসে একটি কমোডিটির দাম কত হবে তা নির্ধারিত হয় আগের কোন এক মাসে। তেলের ক্ষেত্রে এক মাস পর দাম কত হবে তা নির্ধারণ করা হয় আগের মাসে অর্থাৎ মে মাসে তেলের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করা হয় এপ্রিলে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, ডব্লিউটিআই এর ক্ষেত্রে কোন এক মাসের ফিউচারস কন্ট্রাক্ট শেষ হলে সেটেলমেন্টের সময় তেলের ডেলিভারি নিতে হয় বা ঐ কন্ট্রাক্ট অন্য কাউকে বিক্রি করে দিতে হয়। ব্রেন্ট ক্রুডের ক্ষেত্রে নগদ মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে সেটেলমেন্ট হয়; তেল ডেলিভারি নেয়ার দরকার হয়না।
Source: Visual Capitalist |
করোনাভাইরাসের প্রভাবে এই বছরের শুরু থেকেই বিশ্ব অর্থনীতি একরকম স্থবির হয়ে পড়ে, যার বড় রকমের প্রভাব পড়ে তেলের বাজারে। চাহিদা কমার সাথে সাথে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো সে হারে উৎপাদন কমায়নি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যখন সৌদি আরব ও রাশিয়া তেলের বাজারে নিজেদের শেয়ার ধরে রাখতে গিয়ে "তেল যুদ্ধে"(Oil War) জড়িয়ে পড়ে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি থাকায় উৎপাদনকারী দেশগুলোর গুদামে জমতে জমতে থাকে লাখ লাখ ব্যারেল তেল। মিডল ইস্টের দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল মজুদ করার ক্যাপাসিটি এমনিতেই কম। তার উপর চোখ রাঙাচ্ছিলো ডব্লিউটিআই কন্ট্রাক্টের তেল ডেলিভারির মাধ্যমে সেটেলমেন্টের বিষয়টি। অবশেষে যা হওয়ার তাই হয়; মে মাসের কন্ট্রাক্টের শেষ দিন মানে এপ্রিলের ২০ তারিখে সেটেলমেন্টের নিয়ম মেনে তেল ডেলিভারি নেয়ার জন্য উৎপাদকরা উল্টো ক্রেতাদেরকে মুল্য পরিশোধ করেন। ঐদিন ডব্লিউটিআই ক্রুডের সর্বনিম্ন মূল্য ছিলো -৪০ ডলার (প্রতি ব্যারেল), দিনশেষে যা দাঁড়ায় -৩৭.৬৩ ডলারে। ইনভেন্টরি ক্লিয়ারেন্স ও তেল ডেলিভারির মাধ্যমে সেটেলমেন্টের ব্যাপার না থাকার কারণে ব্রেন্ট ক্রুড অবশ্য এরকম ধ্বংসযজ্ঞ দেখেনি; তার দাম ছিল প্রতি ব্যারেলে ২০ ডলারের আশেপাশে।
বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর লকডাউন শিথিল করার সাথে সাথে তেলের চাহিদাও বেড়েছে, দামও অবশ্যই শূন্যের নিচে পড়ে থাকেনি; বরং বেশ বেড়েছে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও কয়েক দফায় উৎপাদন কমিয়েছে যার প্রভাব পড়েছে তেলের দামে। জুনের ৬ তারিখে সংঘটিত হওয়া ওপেকভুক্ত দেশগুলো (OPEC - Organization of Petroleum Exporting Countries) ও রাশিয়ার মধ্যকার বৈঠকে জুলাই মাস পর্যন্ত দিনপ্রতি গড় উৎপাদনের চেয়ে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল কম তেল উৎপাদনের ব্যাপারে উৎপাদনকারী দেশগুলো সম্মত হয়। জুনের শেষে ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েলের দাম ছিলো ব্যারেল প্রতি ৩৯.৩ ডলার আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিলো ৪১.২ ডলার। তারপরো তেলের দাম সহসা গত বছরের লেভেলে মানে ব্যারেল প্রতি ৫৫ - ৬৫ ডলারে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। কারণ আমেরিকান তেলের খনিগুলো এখনো ফুল স্কেলে প্রোডাকশন শুরু করতে পারেনি। তারা এপ্রিল-মের ইনভেন্টরি ক্লিয়ার করতেই ব্যস্ত। আর তেলের চাহিদাও ২০২১ সালের আগে করোনা-পূর্ববর্তী লেভেলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিভিন্ন দেশে এখনো যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি সচল হয়নি। পুরো তেল চাহিদার ১০% যার কাছে, সেই এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির তেলের ব্যবহার করোনা-পূর্ববর্তী লেভেলে ২০২২ সালের আগে যেতে পারবে বলে মনে করছেননা ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টরা। আমেরিকান এনারজি ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশনও (U.S. Energy Information Administration - EIA) অনুমান করছে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫০ ডলারে পৌঁছাতে ২০২১ সাল লেগে যেতে পারে।
Source: Motley fool |
ভারত কি করছে? ভারত বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল আমদানিকারক দেশ; নিজেদের তেল চাহিদার ৮৫% আমদানির মাধ্যমে মিটিয়ে থাকে তারা। দেশটির ৬৫ দিনের তেল মজুদ করে রাখার ক্যাপাসিটি আছে। ভারত ইতোমধ্যেই ৩২ মিলিয়ন টনের বেশি তেল মজুদ করেছে তাদের Strategic Petroleum Reserve এর আওতায়; তেলের কম দামের কারণে ৫০০০ কোটি রুপি খরচ কমানোও সম্ভব হয়েছে। শুধুমাত্র তেল আমদানির জন্য দেশটির তেল মন্ত্রণালয় ৬৭৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চিন্তা করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি ও মজুদের অভিজ্ঞতা এবং স্ট্র্যাটেজিক্যালি এগিয়ে থাকার কারণে তেলের কম দামের সুবিধা ভারত এবং চীন বেশ ভালই নিতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।
এখন দেখা যাক বাংলাদেশ কি করেছে বা করছে। প্রথমেই বাংলাদেশ কিভাবে তেল আমদানি করে এই ব্যাপারে কিছু তথ্য দেয়া যাক। দেশের দৈনিক পেট্রোলিয়াম ফুয়েলের চাহিদা ১৫-২০ হাজার টনের মত। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (Bangladesh Petroleum Corporation - BPC) দুভাবে তেল কেনে - গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (G2G) চুক্তি এবং টেন্ডারের মাধ্যমে। প্রতি মাসে গড়ে ৫-৬ লাখ টন তেল আমদানি হয়; এর মধ্যে ১-১.২ লাখ টন অপরিশোধিত তেল যেটা পুরোটাই কেনা হয় G2G ভিত্তিতে। পরিশোধিত তেল G2G ভিত্তিতে সাতটি দেশের আটটি কোম্পানি থেকে কেনা হয়। কোম্পানিগুলো হল - কুয়েত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, পেট্রোনাস (মালয়েশিয়া), এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি, পিটিটি (থাইল্যান্ড), বুমি সিয়াক পুসাকো (ইন্দোনেশিয়া), পেট্রোচাইনা, ইউনিপ্যাক এবং ভিটল (নেদারল্যান্ড)। এছাড়াও ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে ডিজেল আমদানির জন্য ১৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে; যার অংশ হিসেবে এই বছর ৬০ হাজার টন ডিজেল অয়েল আমদানি হবে। আর টেন্ডারের মাধ্যমে বছরে দুইবার তেল কেনা হয়। তেলের দাম নির্ধারিত হয় সিংগাপুর-ভিত্তিক ম্যাগাজিন, প্ল্যাটস(Platts) এ প্রকাশিত রেট অনুযায়ী। সাথে আরো কিছু চার্জ বা প্রিমিয়াম যেমন ফ্রেইট কস্ট(Freight Cost), ভ্যাট, বিভিন্ন কর, ইত্যাদি যুক্ত হয়। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট বা টেন্ডার যেভাবেই কেনা হোকনা কেন তেলের দাম একই থাকে; প্রিমিয়াম চার্জ বিডিং এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।
Platts Magazine. Source: S&P Global Platts |
প্রকাশিত হিসাব মতে, দেশে ৫০-৬০ দিনের তেল মজুদ করার ক্যাপাসিটি আছে; কিন্তু প্রকৃত হিসাব কিছু কম হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তেলের মজুদ
বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ১ লাখ টন তেল
আমদানির মাধ্যমে মোটামুটি ১০ দিনের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয় এপ্রিল মাসে।
ইতোমধ্যে
বিভিন্ন বেসরকারী
পাওয়ার প্রডিউসারদের কাছে মজুদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারীভাবে মজুদ
বাড়ানোর জন্য পার্বতীপুর,
কক্সবাজার এবং দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল
শোধনাগার (Refinery), ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে কিছু প্রকল্প
নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে।
লকডাউনের কারণে পুরো বিশ্বেই তেলের চাহিদা কমেছে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তেলের চাহিদা কম থাকার কারণে বর্তমান ক্যাপাসিটি অলরেডি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে যার ফলে জ্ররুরি ভিত্তিতে বেশি পরিমাণ তেল দ্রুত মজুদ করা সম্ভব হয়নি। তেলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে তেল মজুদ করার ক্যাপাসিটি খালি হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখার বিষয় হচ্ছে বেসরকারী পাওয়ার প্রডিউসারদের সাথে চুক্তিতে যাওয়ার মাধ্যমে কত দ্রুত কম দামী তেল মজুদ করা যাচ্ছে এবং নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো কত তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে। এই সমস্ত উদ্যোগ ফলপ্রসু হতে যদি বেশি সময় চলে যায়, তাহলে তেলের কম দামের সুবিধা বড় পরিমাণে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
Reference:
1.‘ How Oil Prices Went Subzero: Explaining the COVID-19 Oil Crash
2. Negative oil price: Govt to stock extra 1.1 lakh tonnes of oil
3. পানির দরে’ জ্বালানি তেল, সুযোগ নিতে চায় বিপিসি
4. Unipec, Vitol win tender to supply Bangladesh with fuels in H1 2020
5. Bangladesh failing to cash in on cheap oil price due to lack of storage
6. India uses low crude prices to stockpile 32 million tonnes of oil
7. China has been stockpiling oil for years. Low prices give it reason to buy more
8. China’s crude reserves to reach 1.15 billion barrels in 2020
9. Crude Oil Imports by Country
10. China Doubles Rate Of Crude Stockpiling As Oil Falls Below $0
11. OPEC and Russia Are Likely to Extend Oil Production Cuts
12. The big oil turnaround: From negative prices to a bull market
13. The Future of Oil Demand Is Being Reshaped by Virus Lockdowns
14. Gulf economies to shrink 7.6pc over virus, oil slump: IMF
15. How Bangladesh can cash in on record low oil prices
16. ‘Scary,’ ‘visceral,’ ‘unprecedented’: Traders describe oil’s wild week and fall to negative prices
17. Iraq confirms commitment to reduce production in OPEC + deal
No comments:
Post a Comment