Friday, July 17, 2020

৭০ বছরের ফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবসার পরিসমাপ্তি - GSK এখন Unilever Consumer Care

গত ২০১৮ সালের শেষ দিকে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (GlaxoSmithKline) বা জিএসকে (GSK) তাদের ৭০ বছরের পুরোনো ফার্মা ব্যবসার ইতি টানে। ICI, Pfizer, Nuvista - এর মত আরেকটি বিদেশী কোম্পানি চলে যায় বাংলাদেশ ছেড়ে। একই বছর অ্যাংলো-ডাচ কোম্পানি ইউনিলিভার ওভারসিজ (Unilever Overseas BV) জিএসকের অবশিষ্ট হেলথ ফুড এন্ড ড্রিংক্স বা এইচএফডি (HFD) বিজনেসের ৮২% শেয়ার কিনে নেয়ার কথা ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশে জিএসকের পথচলা ও পরিসমাপ্তি নিয়ে আজকের এই লেখা।

বিশ্ববিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের গল্প ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো। তিন শতক ও তিন মহাদেশের ইতিহাস বহন করে ঔষধ শিল্পে আজো একটি উজ্জ্বল নাম জিএসকে।গত শতকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে মার্জার ও এক্যুইজিশনের মাধ্যমে জিএসকে আজকের রূপ নিলেও কোম্পানিটি তাদের মূলনীতি থেকে সরেনি। আর সেটি হলো নিজেদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে গুণগত মানসম্পন্ন ঔষধ সরবরাহ করা। বিশ্বের ৪১টির বেশি দেশে জিএসকের ১৮০টিরও বেশি নিজস্ব ফ্যাক্টরি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ১৪০টির বেশি মেডিসিন মার্কেটে জিএসকের ঔষধ বিক্রি হয়।


সময়ের হিসাবে জিএসকে 

- প্রতি সেকেন্ডে  ৩০ ডোজের বেশি ভ্যাক্সিন সরবরাহ করে জিএসকে ।

- প্রতি মিনিটে  জিএসকের ঔষধনির্ভর ১১০০টি প্রেসক্রিপশন লেখা হয়।

- প্রতি ঘন্টায়  জিএসকে নতুন প্রোডাক্ট বানাতে ৪৫০,০০০ ডলারের বেশি খরচ করে।



যেভাবে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু

১৯৪৯ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে জিএসকে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাইরে থেকে আমদানির মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পর কোম্পানিটি ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে নিজস্ব ঔষধ ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৬ সালে স্টক মার্কেটে লিস্টেড হয় কোম্পানিটি। প্রধান গ্রুপ কোম্পানির এক্যুইজিশন ফলো করে ১৯৯৫ সালে গ্ল্যাক্সো থেকে গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম বাংলাদেশ (Glaxo Wellcome Bangladesh) এবং ২০০০ সালে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ (GlaxoSmithKline Bangladesh) নামে কোম্পানিটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়। 


বিজনেস সেগমেন্ট
মূলত দুটি বিজনেস লাইন ছিল জিএসকের - ফার্মা এবং কনজিউমার হেলথকেয়ার। শুরু থেকেই ফার্মা বিজনেসে অনেকগুলো সেগমেন্ট বা Therapeutic Area-তে ব্যবসা করেছে জিএসকে। গুণগতমান বজায় রেখে গবেষণানির্ভর ঔষধ অনেকগুলো সেগমেন্টে বিক্রি করে বেশি সংখ্যক কাস্টমার অর্জন করাই ছিলো জিএসকের লক্ষ্য। ভ্যাক্সিনসহ মোট ১৩টি Therapeutic Area তে ৫৭টির ব্র্যান্ডের মেডিসিন বিক্রি করতো জিএসকে। কনজিউমার হেলথকেয়ারে জিএসকের পোর্টফোলিওতে আছে Horlicks, Horlicks Growth Plus, Sensodyne, Boost, Maltova, Glaxose D-এর মত ব্র্যান্ড। ফার্মা বিজনেসে স্ট্রাগল করলেও কনজিউমার হেলথকেয়ার সেগমেন্টে লাভজনকভাবেই ব্যবসা করছে কোম্পানিটি। ২০১৮ সালে ফার্মা বিজনেস বন্ধ হওয়ার আগে ২০১৭ সালের শেষে এই সেগমেন্ট থেকে জিএসকে আয় করে ২১৪ কোটি টাকা যা ২০১৫ তে ছিল ২২১ কোটি টাকা। অপরদিকে কনজিউমার হেলথকেয়ার বিজনেস থেকে ২০১৭ তে আয় হয় ৪৬৫ কোটি টাকা যা ২০১৫ তে ছিল ৪৪৯ কোটি টাকা। ২০১৭ তে জিএসকের মোট প্রফিট ছিলো ৬৭ কোটি, যা ২০১৫ তে ছিল ৮৩ কোটি। কনজিউমার হেলথকেয়ারে লাভ প্রতি বছর বাড়লেও ফার্মা বিজনেসের লসের কারণে পুরো বিজনেস ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিলো।

GSK's Therapeutic Areas & Important Brands. Source: GSK Annual Reports



Source: GSK Annual Reports


যেসব কারণে ফার্মা বিজনেস বন্ধ করলো জিএসকে
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বিদেশী ফার্মা কোম্পানিগুলোর আধিক্য ছিল এবং তারা ব্যবসাও করতো একচেটিয়া। দেশীয় ফার্মা শিল্প বাড়াতে ১৯৮২ সালে প্রণিত আইনে ঔষধের কাঁচামাল এবং তৈরিকৃত ঔষধ আমদানিতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর উপর বেশ কিছু রেস্ট্রিকশন আরোপ করা হয়। তখন থেকে এসব রেস্ট্রিকশনের মধ্যেই ব্যবসা করছিলো বিদেশী ফার্মা কোম্পানিগুলো। তবে জিএসকের ফার্মা বিজনেস বন্ধ হওয়ার মূল কারণ ছিল দেশীয় ফার্মা শিল্পের ইকোসিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হলো এখানে গবেষণাভিত্তিক বা R&D বেইজড ঔষধ নাই বললেই চলে; অন্যভাবে বললে দেশীয় ফার্মা মার্কেটকে একটি ব্র্যান্ডেড জেনেরিক মার্কেট বলা যায়। জেনেরিক মার্কেটের বৈশিষ্ঠ্য হল এখানের অধিকাংশ ঔষধ হচ্ছে জেনেরিক অর্থাৎ আগে প্রচলিত কোন ব্র্যান্ডেড ঔষধের কপি, যেটার তৈরি করার উপাদান, প্রণালী, ব্যবহার প্রণালী, এফেক্ট, সাইড এফেক্ট, ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড ঔষুধটির সাথে পুরোপুরি মিল থাকে। ব্রান্ডেড ঔষুধটির (যেটা থেকে কপি করা হয়) পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তবেই জেনেরিক ঔষুধটি বাজারজাত করার অনুমতি পাওয়া যায়। বিদেশী ফার্মা কোম্পানিগুলোর মধ্যে R&D বেইজড ঔষধ তৈরির প্রবণতা বেশি থাকে; জিএসকেও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা। R&D বেইজড ঔষুধ তৈরিতে খরচ স্বাভাবিকভাবেই জেনেরিক ঔষুধ তৈরির চেয়ে বেশি হয়। জিএসকেও তার প্যারেন্ট কোম্পানির পলিসির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে R&D বেইজড ঔষুধ উৎপাদন বন্ধ করেনি। যার ফলে ঔষধ উৎপাদনে খরচ হচ্ছিলো বেশি আবার রেভিনিউতে গ্রোথ ছিলোনা, ফলশ্রুতিতে ফার্মা সেগমেন্টে লস হচ্ছিলো। রেস্ট্রিকশনের কারণে জিএসকে তার অন্যতম প্রধান দুটি ব্র্যান্ড Evohaler ও Energix-B সহ আমদানিনির্ভর মেডিসিনগুলোতে ব্যবসা হারাচ্ছিলো। তাদের ভ্যাক্সিন সেগমেন্টে তুলনামূলক ভাল অবস্থা থাকলেও আমদানিনির্ভর ভ্যাক্সিনগুলোতেও একইভাবে ব্যবসা হারাচ্ছিলো জিএসকে।

জেনেরিক ঔষুধের আধিক্য ও সহজলভ্যতার কারণে জিএসকের R&D-নির্ভর ঔষুধের চাহিদা দিনদিন কমেছে। Respiratory ও Oncology সেগমেন্টে বেশ কিছু ইনোভেটিভ মেডিসিন আনলেও সেগুলোর চাহিদা তেমন ছিলোনা। তাছাড়া চীন ও ভারত থেকে আমদানিকৃত কম দামী ঔষুধের কাছেও কিছু ব্যবসা হারাচ্ছিলো জিএসকে। সবশেষে দেশীয় কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পারার ব্যাপারটা উল্লেখ না করলেই নয়। দেশীয় কোম্পানিগুলোর এগ্রেসিভ মার্কেটিং ও ডিসট্রিবিউশনের কারণে মার্কেট শেয়ার ও মার্কেট রিচ দুইটাই হারাচ্ছিলো জিএসকে। বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কেটে জিএসকের শেয়ার ছিল ২% এরও কম। মার্কেট রিচ বাড়াতে না পারা ও চাহিদা অনুযায়ী ঔষুধ সরবরাহ করতে না পারার কারণে কাস্টমারদের ডিমান্ডের সাথে জিএসকের প্রোডাক্ট পোর্টফোলিওর একটা বড় রকমের গ্যাপ হয়ে গিয়েছিলো। কম মার্কেট শেয়ারটিকেও ধরে রাখতে না পারা, উল্লেখযোগ্য মার্কেট রিচ অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া, দেশীয় কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পারা, এবং কাঁচামাল ও তৈরি উষুধ আমদানিতে আরোপিত বিধিনিষেধ - এই সবকিছুর কারণে ২০১৩ সাল থেকে ফার্মা বিজনেসে টানা লস করে কোম্পানিটি। অবশেষে ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ফৌজদারহাটের ৫৭ বছরের পুরোনো ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে ফার্মা বিজনেসের ইতি টানতে বাধ্য হয়। জিএসকের ১৩টি Therapeutic Area এর মধ্যে শুধু ভ্যাকসিনগুলোর সরবরাহ অব্যাহত আছে কারণ জিএসকে, সানোফিসহ আরো বেশ কিছু কোম্পানি থেকে ইউনিসেফ ভ্যাকসিন কিনে থাকে।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর থেকে বিদেশী কোম্পানি চলে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৭২ সালে ব্রিটেন-ভিত্তিক ফার্মা কোম্পানি ICI plc. বাংলাদেশে তার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যার নাম ছিলো ICI Bangladesh। ১৯৯২ সালে ICI plc. তাদের শেয়ার ডাইভেস্ট করে লোকাল শেয়ারহোল্ডারদের কাছে এবং কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ACI Ltd.। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছিলো বিশ্ববিখ্যাত ফার্মা কোম্পানি Pfizer, যার নাম ছিল Pfizer (Bangladesh)। ICI-এর মত একই পরিণতি হয় কোম্পানিটির; নাম পরিবর্তন করে এখন Renata Ltd. নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। ২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডভিত্তিক Organon International এর সাবসিডিয়ারি, Nuvista (আগের Organon Bangladesh), একইভাবে শেয়ার ডাইভেস্ট করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। আরেকটি বিদেশী কোম্পানি, Sanofi-ও গতবছর বাংলাদেশ ত্যাগ করার ঘোষণা দেয়।

লসমেকিং এবং অধিক খরচের ফার্মা বিজনেস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জিএসকের প্রফিটেবিলিটি ভাল হয়েছে।২০১৯ সালে কোম্পানিটির গ্রস মার্জিন ছিল ৫৫%, যা আগের বছরগুলোতে ছিলো ৩৫%-৪৫% এর মধ্যে। ফার্মা বিজনেস বন্ধ করাসহ আরো বিভিন্ন ট্রান্সিশনজনিত খরচের কারণে ২০১৮ সালে ৬৪ কোটি টাকা লস করলেও ২০১৯ সালে কোম্পানিটি প্রায় ৯৯ কোটি টাকা লাভ করে।

দৃশ্যপটে  ইউনিলিভারের আবির্ভাব
২০১৮ সালে গ্লোবাল FMCG জায়ান্ট ইউনিলিভার, জিএসকে বাংলাদেশের কনজিউমার হেলথকেয়ার সেগমেন্টের ৮২% কিনে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে এবং ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে দুই কোম্পানি এক্যুইজিশনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসে। যেহেতু এর আগেই জিএসকের ফার্মা বিজনেসটি বন্ধ হয়ে যায়, কার্যত জিএসকে বাংলাদেশের পুরো বিজনেসের মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার হয় ইউনিলিভার। এই এক্যুইজিশনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দেশের স্টক মার্কেটেও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো ইউনিলিভার। এই বছরের ২৮ তারিখ ইউনিভার (Unilever), আগের শেয়ারহোল্ডার সেটফার্স্ট (Setfirst) -এর কাছ থেকে জিএসকে বাংলাদেশের ৮২% বা প্রায় ৯৮.৭৫ লাখ শেয়ার কেনা শেষ করে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্লক মার্কেটে শেয়ারগুলো কিনতে ইউনিভারের খরচ হয় মোট ২০২০.৭৫ কোটি টাকা (শেয়ার প্রতি মূল্য ২০৪৬.৩০ টাকা)। শুধু বাংলাদেশ না, ভারত এবং এশিয়ার আরো ২০টি দেশে জিএসকের যতগুলি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আছে সবগুলোর হেলথ ফুড এবং ড্রিংকস বিজনেস কিনে নিচ্ছে ইউনিভার, যাতে ইউনিলিভারের খরচ হবে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই বছরের এপ্রিলেই ভারতের Hindustan Unilever Ltd. (HUL), এবং GSK Consumer Healthcare India (GSK CH India)-এর সাথে মার্জার সম্পন্ন করেছে। 

ইউনিলিভার ও জিএসকে বাংলাদেশের এই এক্যুইজিশনের পরে জিএসকের নাম হয়েছে ইউনিলিভার কনসিউমার কেয়ার (Unilever Consumer Care)। জিএসকের মূল প্রোডাক্ট পোর্টফোলিওতে কোন পরিবর্তন না আসলেও কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আসবে। নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে জিএসকের আগের ডিরেক্টররাও থাকছেননা; বোর্ডে বসবেন ইউনিলিভার গ্রুপ দ্বারা মনোনীত নতুন ডিরেক্টর। ইউনিলিভার কনসিউমারের অধীনে থাকবে  Horlicks, Boost, ও Glaxose D। Sensodyne ও Eno চলে যাবে জিএসকে গ্রুপের সাবসিডিয়ারি Burroughs Wellcome & Company (Bangladesh)-এর অধীনে। এই এক্যুইজিশনের ফলে ৪১০ কোটি মূল্যের হেলথ ফুড ও ড্রিংকস (HFD) মার্কেটে শক্ত অবস্থান নিতে সমর্থ হবে ইউনিলিভার।



Friday, July 3, 2020

ঋণাত্মক তেলের দাম - তেলের কম দামের সুবিধা কতটুকু নিতে পেরেছে বাংলাদেশ

ই বছরের ২০শে এপ্রিল বিশ্ব বাণিজ্যের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের (Crude Oil) দাম নেমে যায় শূন্যের নিচে, প্রতি ব্যারেলে -৩৭.৬৩ ডলারে। অর্থাৎ নিজেদের মজুদে থাকা প্রতি ব্যারেল তেল সরাতে বিক্রেতারা উল্টো ক্রেতাদেরকে ৩৭.৬ ডলার করে মূল্য দিয়েছেন। এত কম দামে তেল পেয়ে বড় আমদানিকারক দেশগুলোও কিছু সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেছে। পুরো বিষয়টি ব্যাখা করার চেষ্টা করা হয়েছে এই লেখায়।

 

বিশ্ববাজারে বিভিন্ন গ্রেডের অপরিশোধিত তেল আছে; সবচেয়ে পপুলার দুটি গ্রেড হলো - ব্রেন্ট নর্থ সি ক্রুড অয়েল, সংক্ষেপে ব্রেন্ট ক্রুড(Brent Crude) এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট ক্রুড অয়েল, সংক্ষেপে ডব্লিউটিআই ক্রুড (WTI Crude)উত্তর সাগরের আশেপাশের ক্ষেত্র থেকে ব্রেন্ট ক্রুড ওয়েল উত্তোলিত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমার কুশিং (Cushing) এবং তার আশেপাশের বিভিন্ন তেল ক্ষেত্র থেকে উত্তোলিত হয় ডব্লিউটিআই ক্রুড। আফ্রিকা, ইউরোপ ও মিডল ইস্টের দেশগুলোর তেলের দাম নির্ধারিত হয় ব্রেন্ট ক্রুডের মাধ্যমে এবং আমেরিকার ক্ষেত্রে হয় ডব্লিউটিআই ক্রুডের মাধ্যমে। কমোডিটি মার্কেটে তেলসহ আরো বেশ কিছু কমোডিটির ফিউচারস(Futures) ট্রেডিং হয় যেখানে কোন মাসে একটি কমোডিটির দাম কত হবে তা নির্ধারিত হয় আগের কোন এক মাসে। তেলের ক্ষেত্রে এক মাস পর দাম কত হবে তা নির্ধারণ করা হয় আগের মাসে অর্থাৎ মে মাসে তেলের দাম কত হবে তা নির্ধারণ করা হয় এপ্রিলে। আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে হয় যে, ডব্লিউটিআই এর ক্ষেত্রে কোন এক মাসের ফিউচারস কন্ট্রাক্ট শেষ হলে সেটেলমেন্টের সময় তেলের ডেলিভারি নিতে হয় বা ঐ কন্ট্রাক্ট অন্য কাউকে বিক্রি করে দিতে হয়। ব্রেন্ট ক্রুডের ক্ষেত্রে নগদ মূল্য পরিশোধের মাধ্যমে সেটেলমেন্ট হয়; তেল ডেলিভারি নেয়ার দরকার হয়না।

Source: Visual Capitalist



Countries on the edge of North Sea.  Source: Google Map


করোনাভাইরাসের প্রভাবে এই বছরের শুরু থেকেই বিশ্ব অর্থনীতি একরকম স্থবির হয়ে পড়ে, যার বড় রকমের প্রভাব পড়ে তেলের বাজারে। চাহিদা কমার সাথে সাথে তেল উৎপাদনকারী দেশগুলো সে হারে উৎপাদন কমায়নি। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয় যখন সৌদি আরব ও রাশিয়া তেলের বাজারে নিজেদের শেয়ার ধরে রাখতে গিয়ে "তেল যুদ্ধে"(Oil War) জড়িয়ে পড়ে। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন অনেক বেশি থাকায় উৎপাদনকারী দেশগুলোর গুদামে জমতে জমতে থাকে লাখ লাখ ব্যারেল তেল। মিডল ইস্টের দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রের তেল মজুদ করার ক্যাপাসিটি এমনিতেই কম। তার উপর চোখ রাঙাচ্ছিলো ডব্লিউটিআই কন্ট্রাক্টের তেল ডেলিভারির মাধ্যমে সেটেলমেন্টের বিষয়টি। অবশেষে যা হওয়ার তাই হয়; মে মাসের কন্ট্রাক্টের শেষ দিন মানে এপ্রিলের ২০ তারিখে সেটেলমেন্টের নিয়ম মেনে তেল ডেলিভারি নেয়ার জন্য উৎপাদকরা উল্টো ক্রেতাদেরকে মুল্য পরিশোধ করেন। ঐদিন ডব্লিউটিআই ক্রুডের সর্বনিম্ন মূল্য ছিলো -৪০ ডলার (প্রতি ব্যারেল), দিনশেষে যা দাঁড়ায় -৩৭.৬৩ ডলারে। ইনভেন্টরি ক্লিয়ারেন্স ও তেল ডেলিভারির মাধ্যমে সেটেলমেন্টের ব্যাপার না থাকার কারণে ব্রেন্ট ক্রুড অবশ্য এরকম ধ্বংসযজ্ঞ দেখেনি; তার দাম ছিল প্রতি ব্যারেলে ২০ ডলারের আশেপাশে।




Source: FactSet, CNBC

 


Source: Refinitiv, The Economist

বিশ্বব্যাপী দেশগুলোর লকডাউন শিথিল করার সাথে সাথে তেলের চাহিদাও বেড়েছে, দামও অবশ্যই শূন্যের নিচে পড়ে থাকেনি; বরং বেশ বেড়েছে। তেল উৎপাদনকারী দেশগুলোও কয়েক দফায় উৎপাদন কমিয়েছে যার প্রভাব পড়েছে তেলের দামে। জুনের ৬ তারিখে সংঘটিত হওয়া ওপেকভুক্ত দেশগুলো (OPEC - Organization of Petroleum Exporting Countries) ও রাশিয়ার মধ্যকার বৈঠকে জুলাই মাস পর্যন্ত দিনপ্রতি গড় উৎপাদনের চেয়ে ১০ মিলিয়ন ব্যারেল কম তেল উৎপাদনের ব্যাপারে উৎপাদনকারী দেশগুলো সম্মত হয়। জুনের শেষে ডব্লিউটিআই ক্রুড অয়েলের দাম ছিলো ব্যারেল প্রতি ৩৯.৩ ডলার আর ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ছিলো ৪১.২ ডলার। তারপরো তেলের দাম সহসা গত বছরের লেভেলে মানে ব্যারেল প্রতি ৫৫ - ৬৫ ডলারে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। কারণ আমেরিকান তেলের খনিগুলো এখনো ফুল স্কেলে প্রোডাকশন শুরু করতে পারেনি। তারা এপ্রিল-মের ইনভেন্টরি ক্লিয়ার করতেই ব্যস্ত। আর তেলের চাহিদাও ২০২১ সালের আগে করোনা-পূর্ববর্তী লেভেলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বিভিন্ন দেশে এখনো যাতায়াত ব্যবস্থা পুরোপুরি সচল হয়নি। পুরো তেল চাহিদার ১০% যার কাছে, সেই এভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রির তেলের ব্যবহার করোনা-পূর্ববর্তী লেভেলে ২০২২ সালের আগে যেতে পারবে বলে মনে করছেননা ইন্ডাস্ট্রি এক্সপার্টরাআমেরিকান এনারজি ইনফরমেশন এডমিনিস্ট্রেশনও (U.S. Energy Information Administration - EIA) অনুমান করছে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ৫০ ডলারে পৌঁছাতে ২০২১ সাল লেগে যেতে পারে।

 

 


                                                                                Source: Motley fool


উপরের এনালাইসিস থেকে এটুকু বলা যেতে পারে, তেলের চাহিদা, উৎপাদন ও মূল্য করোনা-পূর্ববর্তী লেভেলে যেতে বেশ সময় লেগে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে তেল আমদানিকারক দেশগুলোর সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা উচিত। যেসব দেশের বেশি তেল মজুদ করে রাখার ভাল ক্যাপাসিটি আছে সেসব দেশ তেলের কম দামের সুবিধা বেশি নিতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে চীন ও ভারতের কথা বলা যেতে পারে। তেলের দাম ২০ ডলারে নামার সাথে সাথে চীন দৈনিক তেলের মজুদের হার (Stockpiling rate) দ্বিগুণ করে দেয়ার ঘোষণা দেয়। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন এই বছর শেষে চীনের তেলের মজুদ ১ বিলিয়ন ব্যারেল ছাড়াতে পারেঅবশ্য শুধু তেলের কম দামের সুবিধা নিতে চীন মজুদ বাড়াচ্ছে তা না। চীন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি তেল আমদানিকারক দেশ; পুরো আমদানিকৃত তেলের ২৩% চীন একা করে। করোনাভাইরাসের কারণে আরোপকৃত লকডাউন শিথিল হওয়ার পরে চীনের অর্থনীতি দ্রুততম গতিতে ঘুরে দাঁড়ানোর পথে আছে। তেলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে মজুদের সামঞ্জস্য রাখতেই চীন দ্রুতগতিতে স্টকপাইলিং করছে।

ভারত কি করছে? ভারত বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ তেল আমদানিকারক দেশ; নিজেদের তেল চাহিদার ৮৫% আমদানির মাধ্যমে মিটিয়ে থাকে তারা। দেশটির ৬৫ দিনের তেল মজুদ করে রাখার ক্যাপাসিটি আছে। ভারত ইতোমধ্যেই ৩২ মিলিয়ন টনের বেশি তেল মজুদ করেছে তাদের Strategic Petroleum Reserve এর আওতায়; তেলের কম দামের কারণে ৫০০০ কোটি রুপি খরচ কমানোও সম্ভব হয়েছে। শুধুমাত্র তেল আমদানির জন্য দেশটির তেল মন্ত্রণালয় ৬৭৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের চিন্তা করছে। দীর্ঘদিন ধরে বিপুল পরিমাণ তেল আমদানি ও মজুদের অভিজ্ঞতা এবং স্ট্র্যাটেজিক্যালি এগিয়ে থাকার কারণে তেলের কম দামের সুবিধা ভারত এবং চীন বেশ ভালই নিতে পেরেছে বলে মনে হচ্ছে।

 

এখন দেখা যাক বাংলাদেশ কি করেছে বা করছে। প্রথমেই বাংলাদেশ কিভাবে তেল আমদানি করে এই ব্যাপারে কিছু তথ্য দেয়া যাক। দেশের দৈনিক পেট্রোলিয়াম ফুয়েলের চাহিদা ১৫-২০ হাজার টনের মত। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (Bangladesh Petroleum Corporation - BPC) দুভাবে তেল কেনে - গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট (G2G) চুক্তি এবং টেন্ডারের মাধ্যমে। প্রতি মাসে গড়ে ৫-৬ লাখ টন তেল আমদানি হয়; এর মধ্যে ১-১.২ লাখ টন অপরিশোধিত তেল যেটা পুরোটাই কেনা হয় G2G ভিত্তিতে। পরিশোধিত তেল G2G ভিত্তিতে সাতটি দেশের আটটি কোম্পানি থেকে কেনা হয়। কোম্পানিগুলো হল - কুয়েত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন, পেট্রোনাস (মালয়েশিয়া), এমিরেটস ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি, পিটিটি (থাইল্যান্ড), বুমি সিয়াক পুসাকো (ইন্দোনেশিয়া), পেট্রোচাইনা, ইউনিপ্যাক এবং ভিটল (নেদারল্যান্ড)। এছাড়াও ভারতের নুমালিগড় রিফাইনারি থেকে ডিজেল আমদানির জন্য ১৫ বছরের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে; যার অংশ হিসেবে এই বছর ৬০ হাজার টন ডিজেল অয়েল আমদানি হবে। আর টেন্ডারের মাধ্যমে বছরে দুইবার তেল কেনা হয়। তেলের দাম নির্ধারিত হয় সিংগাপুর-ভিত্তিক ম্যাগাজিন, প্ল্যাটস(Platts) এ প্রকাশিত রেট অনুযায়ী। সাথে আরো কিছু চার্জ বা প্রিমিয়াম যেমন ফ্রেইট কস্ট(Freight Cost), ভ্যাট, বিভিন্ন কর, ইত্যাদি যুক্ত হয়। গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট বা টেন্ডার যেভাবেই কেনা হোকনা কেন তেলের দাম একই থাকে; প্রিমিয়াম চার্জ বিডিং এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।


Platts Magazine. Source: S&P Global Platts


প্রকাশিত হিসাব মতে, দেশে ৫০-৬০ দিনের তেল মজুদ করার ক্যাপাসিটি আছে; কিন্তু প্রকৃত হিসাব কিছু কম হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তেলের মজুদ বাড়ানোর জন্য ইতোমধ্যে কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জরুরী ভিত্তিতে ১ লাখ টন তেল আমদানির মাধ্যমে মোটামুটি ১০ দিনের মজুদ বাড়ানোর উদ্যোগ নেয়া হয় এপ্রিল মাসে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বেসরকারী পাওয়ার প্রডিউসারদের কাছে মজুদ বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। সরকারীভাবে মজুদ বাড়ানোর জন্য পার্বতীপুর, কক্সবাজার এবং দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল শোধনাগার (Refinery), ইস্টার্ণ রিফাইনারিতে কিছু প্রকল্প নির্মাণাধীন অবস্থায় আছে।

লকডাউনের কারণে পুরো বিশ্বেই তেলের চাহিদা কমেছে; বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। তেলের চাহিদা কম থাকার কারণে বর্তমান ক্যাপাসিটি অলরেডি পূর্ণ হয়ে গিয়েছে যার ফলে জ্ররুরি ভিত্তিতে বেশি পরিমাণ তেল দ্রুত মজুদ করা সম্ভব হয়নি। তেলের চাহিদা বাড়ার সাথে সাথে তেল মজুদ করার ক্যাপাসিটি খালি হবে। কিন্তু এক্ষেত্রে দেখার বিষয় হচ্ছে বেসরকারী পাওয়ার প্রডিউসারদের সাথে চুক্তিতে যাওয়ার মাধ্যমে কত দ্রুত কম দামী তেল মজুদ করা যাচ্ছে এবং নির্মাণাধীন প্রকল্পগুলো কত তাড়াতাড়ি শেষ হচ্ছে। এই সমস্ত উদ্যোগ ফলপ্রসু হতে যদি বেশি সময় চলে যায়, তাহলে তেলের কম দামের সুবিধা বড় পরিমাণে নেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।


Reference:

 

1. How Oil Prices Went Subzero: Explaining the COVID-19 Oil Crash

2Negative oil price: Govt to stock extra 1.1 lakh tonnes of oil

3পানির দরেজ্বালানি তেল, সুযোগ নিতে চায় বিপিসি

4Unipec, Vitol win tender to supply Bangladesh with fuels in H1 2020

5Bangladesh failing to cash in on cheap oil price due to lack of storage

6. India uses low crude prices to stockpile 32 million tonnes of oil

7. China has been stockpiling oil for years. Low prices give it reason to buy more

8China’s crude reserves to reach 1.15 billion barrels in 2020

9. Crude Oil Imports by Country

10China Doubles Rate Of Crude Stockpiling As Oil Falls Below $0

11. OPEC and Russia Are Likely to Extend Oil Production Cuts

12. The big oil turnaround: From negative prices to a bull market

13. The Future of Oil Demand Is Being Reshaped by Virus Lockdowns

14. Gulf economies to shrink 7.6pc over virus, oil slump: IMF

15. How Bangladesh can cash in on record low oil prices

16. Scary,’ ‘visceral,’ ‘unprecedented’: Traders describe oil’s wild week and fall to negative prices

17. Iraq confirms commitment to reduce production in OPEC + deal