Friday, July 17, 2020

৭০ বছরের ফার্মাসিউটিক্যালস ব্যবসার পরিসমাপ্তি - GSK এখন Unilever Consumer Care

গত ২০১৮ সালের শেষ দিকে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন (GlaxoSmithKline) বা জিএসকে (GSK) তাদের ৭০ বছরের পুরোনো ফার্মা ব্যবসার ইতি টানে। ICI, Pfizer, Nuvista - এর মত আরেকটি বিদেশী কোম্পানি চলে যায় বাংলাদেশ ছেড়ে। একই বছর অ্যাংলো-ডাচ কোম্পানি ইউনিলিভার ওভারসিজ (Unilever Overseas BV) জিএসকের অবশিষ্ট হেলথ ফুড এন্ড ড্রিংক্স বা এইচএফডি (HFD) বিজনেসের ৮২% শেয়ার কিনে নেয়ার কথা ঘোষণা দেয়। বাংলাদেশে জিএসকের পথচলা ও পরিসমাপ্তি নিয়ে আজকের এই লেখা।

বিশ্ববিখ্যাত ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইনের গল্প ৩০০ বছরের বেশি পুরোনো। তিন শতক ও তিন মহাদেশের ইতিহাস বহন করে ঔষধ শিল্পে আজো একটি উজ্জ্বল নাম জিএসকে।গত শতকের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কোম্পানির মধ্যে মার্জার ও এক্যুইজিশনের মাধ্যমে জিএসকে আজকের রূপ নিলেও কোম্পানিটি তাদের মূলনীতি থেকে সরেনি। আর সেটি হলো নিজেদের গবেষণার উপর ভিত্তি করে গুণগত মানসম্পন্ন ঔষধ সরবরাহ করা। বিশ্বের ৪১টির বেশি দেশে জিএসকের ১৮০টিরও বেশি নিজস্ব ফ্যাক্টরি রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ১৪০টির বেশি মেডিসিন মার্কেটে জিএসকের ঔষধ বিক্রি হয়।


সময়ের হিসাবে জিএসকে 

- প্রতি সেকেন্ডে  ৩০ ডোজের বেশি ভ্যাক্সিন সরবরাহ করে জিএসকে ।

- প্রতি মিনিটে  জিএসকের ঔষধনির্ভর ১১০০টি প্রেসক্রিপশন লেখা হয়।

- প্রতি ঘন্টায়  জিএসকে নতুন প্রোডাক্ট বানাতে ৪৫০,০০০ ডলারের বেশি খরচ করে।



যেভাবে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু

১৯৪৯ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করে জিএসকে। ১০ বছরের বেশি সময় ধরে বাইরে থেকে আমদানির মাধ্যমে ব্যবসা চালিয়ে যাওয়ার পর কোম্পানিটি ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটে নিজস্ব ঔষধ ম্যানুফ্যাকচারিং ফ্যাক্টরি প্রতিষ্ঠা করে। ১৯৭৬ সালে স্টক মার্কেটে লিস্টেড হয় কোম্পানিটি। প্রধান গ্রুপ কোম্পানির এক্যুইজিশন ফলো করে ১৯৯৫ সালে গ্ল্যাক্সো থেকে গ্ল্যাক্সো ওয়েলকাম বাংলাদেশ (Glaxo Wellcome Bangladesh) এবং ২০০০ সালে গ্ল্যাক্সোস্মিথক্লাইন বাংলাদেশ (GlaxoSmithKline Bangladesh) নামে কোম্পানিটি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়। 


বিজনেস সেগমেন্ট
মূলত দুটি বিজনেস লাইন ছিল জিএসকের - ফার্মা এবং কনজিউমার হেলথকেয়ার। শুরু থেকেই ফার্মা বিজনেসে অনেকগুলো সেগমেন্ট বা Therapeutic Area-তে ব্যবসা করেছে জিএসকে। গুণগতমান বজায় রেখে গবেষণানির্ভর ঔষধ অনেকগুলো সেগমেন্টে বিক্রি করে বেশি সংখ্যক কাস্টমার অর্জন করাই ছিলো জিএসকের লক্ষ্য। ভ্যাক্সিনসহ মোট ১৩টি Therapeutic Area তে ৫৭টির ব্র্যান্ডের মেডিসিন বিক্রি করতো জিএসকে। কনজিউমার হেলথকেয়ারে জিএসকের পোর্টফোলিওতে আছে Horlicks, Horlicks Growth Plus, Sensodyne, Boost, Maltova, Glaxose D-এর মত ব্র্যান্ড। ফার্মা বিজনেসে স্ট্রাগল করলেও কনজিউমার হেলথকেয়ার সেগমেন্টে লাভজনকভাবেই ব্যবসা করছে কোম্পানিটি। ২০১৮ সালে ফার্মা বিজনেস বন্ধ হওয়ার আগে ২০১৭ সালের শেষে এই সেগমেন্ট থেকে জিএসকে আয় করে ২১৪ কোটি টাকা যা ২০১৫ তে ছিল ২২১ কোটি টাকা। অপরদিকে কনজিউমার হেলথকেয়ার বিজনেস থেকে ২০১৭ তে আয় হয় ৪৬৫ কোটি টাকা যা ২০১৫ তে ছিল ৪৪৯ কোটি টাকা। ২০১৭ তে জিএসকের মোট প্রফিট ছিলো ৬৭ কোটি, যা ২০১৫ তে ছিল ৮৩ কোটি। কনজিউমার হেলথকেয়ারে লাভ প্রতি বছর বাড়লেও ফার্মা বিজনেসের লসের কারণে পুরো বিজনেস ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছিলো।

GSK's Therapeutic Areas & Important Brands. Source: GSK Annual Reports



Source: GSK Annual Reports


যেসব কারণে ফার্মা বিজনেস বন্ধ করলো জিএসকে
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে বিদেশী ফার্মা কোম্পানিগুলোর আধিক্য ছিল এবং তারা ব্যবসাও করতো একচেটিয়া। দেশীয় ফার্মা শিল্প বাড়াতে ১৯৮২ সালে প্রণিত আইনে ঔষধের কাঁচামাল এবং তৈরিকৃত ঔষধ আমদানিতে বিদেশী কোম্পানিগুলোর উপর বেশ কিছু রেস্ট্রিকশন আরোপ করা হয়। তখন থেকে এসব রেস্ট্রিকশনের মধ্যেই ব্যবসা করছিলো বিদেশী ফার্মা কোম্পানিগুলো। তবে জিএসকের ফার্মা বিজনেস বন্ধ হওয়ার মূল কারণ ছিল দেশীয় ফার্মা শিল্পের ইকোসিস্টেমের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা। বাংলাদেশের ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টরের একটি বিশেষ বৈশিষ্ঠ্য হলো এখানে গবেষণাভিত্তিক বা R&D বেইজড ঔষধ নাই বললেই চলে; অন্যভাবে বললে দেশীয় ফার্মা মার্কেটকে একটি ব্র্যান্ডেড জেনেরিক মার্কেট বলা যায়। জেনেরিক মার্কেটের বৈশিষ্ঠ্য হল এখানের অধিকাংশ ঔষধ হচ্ছে জেনেরিক অর্থাৎ আগে প্রচলিত কোন ব্র্যান্ডেড ঔষধের কপি, যেটার তৈরি করার উপাদান, প্রণালী, ব্যবহার প্রণালী, এফেক্ট, সাইড এফেক্ট, ইত্যাদি ব্র্যান্ডেড ঔষুধটির সাথে পুরোপুরি মিল থাকে। ব্রান্ডেড ঔষুধটির (যেটা থেকে কপি করা হয়) পেটেন্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে তবেই জেনেরিক ঔষুধটি বাজারজাত করার অনুমতি পাওয়া যায়। বিদেশী ফার্মা কোম্পানিগুলোর মধ্যে R&D বেইজড ঔষধ তৈরির প্রবণতা বেশি থাকে; জিএসকেও তার ব্যতিক্রম ছিলোনা। R&D বেইজড ঔষুধ তৈরিতে খরচ স্বাভাবিকভাবেই জেনেরিক ঔষুধ তৈরির চেয়ে বেশি হয়। জিএসকেও তার প্যারেন্ট কোম্পানির পলিসির সাথে তাল মেলাতে গিয়ে R&D বেইজড ঔষুধ উৎপাদন বন্ধ করেনি। যার ফলে ঔষধ উৎপাদনে খরচ হচ্ছিলো বেশি আবার রেভিনিউতে গ্রোথ ছিলোনা, ফলশ্রুতিতে ফার্মা সেগমেন্টে লস হচ্ছিলো। রেস্ট্রিকশনের কারণে জিএসকে তার অন্যতম প্রধান দুটি ব্র্যান্ড Evohaler ও Energix-B সহ আমদানিনির্ভর মেডিসিনগুলোতে ব্যবসা হারাচ্ছিলো। তাদের ভ্যাক্সিন সেগমেন্টে তুলনামূলক ভাল অবস্থা থাকলেও আমদানিনির্ভর ভ্যাক্সিনগুলোতেও একইভাবে ব্যবসা হারাচ্ছিলো জিএসকে।

জেনেরিক ঔষুধের আধিক্য ও সহজলভ্যতার কারণে জিএসকের R&D-নির্ভর ঔষুধের চাহিদা দিনদিন কমেছে। Respiratory ও Oncology সেগমেন্টে বেশ কিছু ইনোভেটিভ মেডিসিন আনলেও সেগুলোর চাহিদা তেমন ছিলোনা। তাছাড়া চীন ও ভারত থেকে আমদানিকৃত কম দামী ঔষুধের কাছেও কিছু ব্যবসা হারাচ্ছিলো জিএসকে। সবশেষে দেশীয় কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পারার ব্যাপারটা উল্লেখ না করলেই নয়। দেশীয় কোম্পানিগুলোর এগ্রেসিভ মার্কেটিং ও ডিসট্রিবিউশনের কারণে মার্কেট শেয়ার ও মার্কেট রিচ দুইটাই হারাচ্ছিলো জিএসকে। বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যালস মার্কেটে জিএসকের শেয়ার ছিল ২% এরও কম। মার্কেট রিচ বাড়াতে না পারা ও চাহিদা অনুযায়ী ঔষুধ সরবরাহ করতে না পারার কারণে কাস্টমারদের ডিমান্ডের সাথে জিএসকের প্রোডাক্ট পোর্টফোলিওর একটা বড় রকমের গ্যাপ হয়ে গিয়েছিলো। কম মার্কেট শেয়ারটিকেও ধরে রাখতে না পারা, উল্লেখযোগ্য মার্কেট রিচ অর্জন করতে ব্যর্থ হওয়া, দেশীয় কোম্পানিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতায় ঠিকতে না পারা, এবং কাঁচামাল ও তৈরি উষুধ আমদানিতে আরোপিত বিধিনিষেধ - এই সবকিছুর কারণে ২০১৩ সাল থেকে ফার্মা বিজনেসে টানা লস করে কোম্পানিটি। অবশেষে ২০১৮ সালে কোম্পানিটি ফৌজদারহাটের ৫৭ বছরের পুরোনো ফ্যাক্টরিটি বন্ধ করে দেয়ার মাধ্যমে ফার্মা বিজনেসের ইতি টানতে বাধ্য হয়। জিএসকের ১৩টি Therapeutic Area এর মধ্যে শুধু ভ্যাকসিনগুলোর সরবরাহ অব্যাহত আছে কারণ জিএসকে, সানোফিসহ আরো বেশ কিছু কোম্পানি থেকে ইউনিসেফ ভ্যাকসিন কিনে থাকে।

বাংলাদেশ ফার্মাসিউটিক্যাল সেক্টর থেকে বিদেশী কোম্পানি চলে যাওয়ার ঘটনা এটাই প্রথম নয়। ১৯৭২ সালে ব্রিটেন-ভিত্তিক ফার্মা কোম্পানি ICI plc. বাংলাদেশে তার সাবসিডিয়ারি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করে যার নাম ছিলো ICI Bangladesh। ১৯৯২ সালে ICI plc. তাদের শেয়ার ডাইভেস্ট করে লোকাল শেয়ারহোল্ডারদের কাছে এবং কোম্পানির নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় ACI Ltd.। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছিলো বিশ্ববিখ্যাত ফার্মা কোম্পানি Pfizer, যার নাম ছিল Pfizer (Bangladesh)। ICI-এর মত একই পরিণতি হয় কোম্পানিটির; নাম পরিবর্তন করে এখন Renata Ltd. নামে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে কোম্পানিটি। ২০০৬ সালে নেদারল্যান্ডভিত্তিক Organon International এর সাবসিডিয়ারি, Nuvista (আগের Organon Bangladesh), একইভাবে শেয়ার ডাইভেস্ট করে বাংলাদেশ ত্যাগ করে। আরেকটি বিদেশী কোম্পানি, Sanofi-ও গতবছর বাংলাদেশ ত্যাগ করার ঘোষণা দেয়।

লসমেকিং এবং অধিক খরচের ফার্মা বিজনেস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জিএসকের প্রফিটেবিলিটি ভাল হয়েছে।২০১৯ সালে কোম্পানিটির গ্রস মার্জিন ছিল ৫৫%, যা আগের বছরগুলোতে ছিলো ৩৫%-৪৫% এর মধ্যে। ফার্মা বিজনেস বন্ধ করাসহ আরো বিভিন্ন ট্রান্সিশনজনিত খরচের কারণে ২০১৮ সালে ৬৪ কোটি টাকা লস করলেও ২০১৯ সালে কোম্পানিটি প্রায় ৯৯ কোটি টাকা লাভ করে।

দৃশ্যপটে  ইউনিলিভারের আবির্ভাব
২০১৮ সালে গ্লোবাল FMCG জায়ান্ট ইউনিলিভার, জিএসকে বাংলাদেশের কনজিউমার হেলথকেয়ার সেগমেন্টের ৮২% কিনে নেয়ার ইচ্ছা পোষণ করে এবং ওই বছরের ডিসেম্বর মাসে দুই কোম্পানি এক্যুইজিশনের ব্যাপারে সমঝোতায় আসে। যেহেতু এর আগেই জিএসকের ফার্মা বিজনেসটি বন্ধ হয়ে যায়, কার্যত জিএসকে বাংলাদেশের পুরো বিজনেসের মেজরিটি শেয়ারহোল্ডার হয় ইউনিলিভার। এই এক্যুইজিশনের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে দেশের স্টক মার্কেটেও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেলো ইউনিলিভার। এই বছরের ২৮ তারিখ ইউনিভার (Unilever), আগের শেয়ারহোল্ডার সেটফার্স্ট (Setfirst) -এর কাছ থেকে জিএসকে বাংলাদেশের ৮২% বা প্রায় ৯৮.৭৫ লাখ শেয়ার কেনা শেষ করে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ব্লক মার্কেটে শেয়ারগুলো কিনতে ইউনিভারের খরচ হয় মোট ২০২০.৭৫ কোটি টাকা (শেয়ার প্রতি মূল্য ২০৪৬.৩০ টাকা)। শুধু বাংলাদেশ না, ভারত এবং এশিয়ার আরো ২০টি দেশে জিএসকের যতগুলি সাবসিডিয়ারি কোম্পানি আছে সবগুলোর হেলথ ফুড এবং ড্রিংকস বিজনেস কিনে নিচ্ছে ইউনিভার, যাতে ইউনিলিভারের খরচ হবে ৩.৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এই বছরের এপ্রিলেই ভারতের Hindustan Unilever Ltd. (HUL), এবং GSK Consumer Healthcare India (GSK CH India)-এর সাথে মার্জার সম্পন্ন করেছে। 

ইউনিলিভার ও জিএসকে বাংলাদেশের এই এক্যুইজিশনের পরে জিএসকের নাম হয়েছে ইউনিলিভার কনসিউমার কেয়ার (Unilever Consumer Care)। জিএসকের মূল প্রোডাক্ট পোর্টফোলিওতে কোন পরিবর্তন না আসলেও কাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আসবে। নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে জিএসকের আগের ডিরেক্টররাও থাকছেননা; বোর্ডে বসবেন ইউনিলিভার গ্রুপ দ্বারা মনোনীত নতুন ডিরেক্টর। ইউনিলিভার কনসিউমারের অধীনে থাকবে  Horlicks, Boost, ও Glaxose D। Sensodyne ও Eno চলে যাবে জিএসকে গ্রুপের সাবসিডিয়ারি Burroughs Wellcome & Company (Bangladesh)-এর অধীনে। এই এক্যুইজিশনের ফলে ৪১০ কোটি মূল্যের হেলথ ফুড ও ড্রিংকস (HFD) মার্কেটে শক্ত অবস্থান নিতে সমর্থ হবে ইউনিলিভার।



No comments:

Post a Comment