Wednesday, October 17, 2018

ভাওয়াল সন্ন্যাসী রাজা - The King who lived two lives

বই পড়ে মুভি অনেক দেখছি, কিন্তু কোন জায়গা ঘুরে এসে ঐটার কাহিনী নিয়ে মুভি দেখার সুযোগ কখনো আসবে ভাবিনাই। তার উপর জায়গাটাও বেশ কাছেই, গাজীপুরে। যদিও গিয়ে বেশি কিছু পাইনাই, মানে ইতিহাসের ছাপ পাইনাই আরকি; আগের সব বিল্ডিংরে সরকারি কার্যালয়, স্কুল, কোয়ার্টার বানায় ফেলছে। যাইতেও প্যারা হয়নাই বেশি; অনাবিল বাসে করে গাজীপুর চৌরাস্তা, সেখান থেকে অটো করে রাজবাড়ি।

এই ভবনটা একটু কম এডিট করছে 😀
ভাওয়াল জমিদার বংশের রাজা রমেন্দ্রনারায়ণ রায়ের মৃত্যুর পর ফিরে আসার কাহিনী বেশ বিখ্যাত ও চাঞ্চল্যকর। লেখার খাতিরে একটু পেছনে যাওয়া যাক। মোটামুটি ৩০০ বছর আগে ১৭০০ সালের দিকে ভাওয়াল পরগণা জমিদারীর দেওয়ান (Proctor) হন বাংলার প্রথম স্বাধীন নবাব মুর্শিদকুলী খান। মোটা অংকের রাজস্ব দেয়ার লোভ দেখিয়ে অন্য অঞ্চলের হিন্দু জমিদাররা নবাবের কাছ থেকে ভাওয়াল অঞ্চলের জমিদা্রী পান। বিভিন্ন হাত ঘুরে এই জমিদারী যায় কালীনারায়ণ রায়চৌধুরীর কাছে। তার ছেলে রাজেন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী এই জমিদারীকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, গাজীপুরসহ আরো অনেক এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত করেন। বিখ্যাত সাহিত্যিক কালীপ্রসন্ন ঘোষ ছিলেন তার দেওয়ান। এই রাজেন্দ্রনারায়ণের তিন ছেলে রণেন্দ্র, রমেন্দ্র ও রবীন্দ্রনারায়ণ রায়চৌধুরী ( নামতো না একেকজন কয়েকটা জিলা নিয়া বইসে )।   



জমিদারবাড়ির পুকুর
১৯০৪ সালে রাজেন্দ্রনারায়ণ মারা যাওয়ার সময় তার তিন ছেলেই ছিলেন নাবালক। তারা সাবালক হওয়ার পর তাদের হাতে জমিদারী যায়। কিন্তু উদাসীনতা আর অজ্ঞতার কারণে জমিদারীর দেখার অযোগ্য ছিলেন মোটামুটি তিনজনই। এর মধ্যে রমেন্দ্রনারায়ণের মদ আর নারীর নেশা ছিলো প্রবল। অতিরিক্ত নারীলিপ্সুতার ফল যা হবার তাই হলো, সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। অনেক ইতিহাসবিদ দাবী করেন, স্বামীর নারীলিপ্সুতায় হতাশ হয়ে রমেন্দ্রর স্ত্রী বিভাবতী দেবী রাজার ব্যক্তিগত ডাক্তার আশুতোষ দাসগুপ্তের সাথে প্রণয়ে জড়িয়ে পড়েন। এদিকে দৃশ্যপটে হাজির হন বিভাবতী দেবীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী; রমেন্দ্রনারায়ণের এসব দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জমিদারী হাতিয়ে নেয়ার পায়তারা করতে থাকে সে। পরবর্তীতে রাজাকে রাণী বিভাবতী, রাজার ব্যক্তিগত ডাক্তার আশুতোষ, রাণীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথসহ মোটামুটি বিশ জনকে হাওয়া বদলের জন্য দার্জিলিং পাঠিয়ে দেয়া হয়।দার্জিলিং গিয়ে রাজার অবস্থা আরো খারাপ হয়। অনেকে এটাও বলেন, রাণী বিভাবতী দেবী আর তার ভাই মিলে খাবার, ঔষুধ ইত্যাদির মধ্যে বিষ মিশিয়ে রাজাকে তিলে তিলে মারার ষড়যন্ত্র করেন। একদিন এক টেলিগ্রাম আসে যাতে লেখা ছিলো “রমেন্দ্রনারায়ণ ইজ নো মোর”। মৃত্যুর কারণ হিসেবে গলব্লাডারে পাথরের কথা উল্লেখ করেন দার্জিলিঙের সার্জন। শেষকৃত্যের পাট চুকিয়ে জমিদার বাড়িতে এসে পরে কলকাতায় ফিরে যান রাণী বিভাবতী ও তার ভাই। 

কাহিনীতো অন্য জায়গায়; রাজার শেষকৃত্যই যে হয়নাই। সৎকারের দিন প্রচন্ড শিলাবৃষ্টি হয়; উপস্থিত সবাই রাজার মৃতদেহ শ্মশানের কাছে রেখে বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছিল। বৃষ্টি থামার পর গিয়ে দেখে মৃতদেহ গায়েব। শেয়াল কুকুরে মৃতদেহ নিয়ে গেছে ভেবে সবাই ফিরে আসে। এই খবর ধামাচাপার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। তারপরো অনেকের আশা ছিল রাজা ফিরে আসবেন একদিন। এদিকে বছরের পর বছর চলে যায়, রাজার খবর নাই। রাজার বাকি দুইভাই মারা যান; জমিদারী একসময় পুরোপুরি ব্রিটিশদের হাতে চলে যায়। একযুগ পরে ১৯২১ সালে একদিন বুড়িগঙ্গার দক্ষিণ পাশে বাকল্যান্ড বাঁধ এলাকায় এক জটাধারী সন্ন্যাসীর দেখা পাওয়া যায়, অবিকল রমেন্দ্রনারায়ণের মত দেখতে। তার ছোটবোন জ্যোতির্ময়ী দেবীকে খবর দেয়া হলো। তিনি এসে সন্ন্যাসীকে দেখে তো হা! তার উপর সন্ন্যাসীর গায়ের দাগের সাথে রাজার গায়ে শিকারের দাগ আর জন্মদাগের মিল খুঁজে পান তার বোন। উৎসুক মানুষের বিভিন্ন প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেন তিনি; দার্জিলিঙের ঘটনারও সঠিক বর্ণনা দেন। তিনি আরো বলেন, জঙ্গলের সন্ন্যাসীরা তাকে বৃষ্টিভেজা অবস্থায় খুঁজে পায়; তাকে সেবা করে বাঁচিয়ে তুলে। তাদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণের মাধ্যমে আস্তে আস্তে তার স্মৃতি ফেরত এসেছে। 

এসব ঘটনার পর রাজা রমেন্দ্রর আইনজীবিরা জমিদারীর অংশ চেয়ে মামলা করে বসেন। জমিদারী তখন ভোগ করছিলেন বিভাবতী দেবী, তার ভাই সত্যেন্দ্রনাথ এবং তার স্ত্রী। এটাই ঐতিহাসিক ‘ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা’ নামে খ্যাত। দুইপক্ষেই অনেক যুক্তি, প্রমাণের সাহায্য নেয়া হয়। রাজা নাকি অনেক শিক্ষিত ছিলেন, সন্ন্যাসী শিক্ষিত না- এই যুক্তিও দেখানো হয়; পরে প্রমাণিত হয় রাজাও মোটামুটি নিরক্ষরই ছিলেন (খেলাধুলায় মত্ত ছিলেন তাই শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পাননাই )। রাজা ইংরেজি, বাংলা বলতে পারতেন; সন্ন্যাসী উর্দুতে কথা বলতেন। পরে রাজার ইংরেজি আর বাংলাভাষাজ্ঞানের প্রমাণ হিসেবে যে চিঠিগুলো আদালতে পেশ করা হয় ঐগুলো জাল বলে প্রমাণিত হয়। এভাবে ১৯৩০ সালে শুরু হওয়া মামলা ১৯৩৬ এ শেষ হয়। আরেকটি মামলা ১৯৪৬ সালে শেষ হয়; দুটি মামলার রায়ই রাজার পক্ষে যায়। পক্ষে রায় পেয়েও বেশি লাভ হয়নাই; মামলা জিতার কয়েক মাস পরেই মারা যান রাজা রমেন্দ্র। বর্তমানে ভাওয়াল এস্টেটের কর্মকাণ্ড গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ভূমি সংস্কার বোর্ড পরিচালনা করে।  

এইরকম চাঞ্চল্যকর কাহিনী নিয়ে ওপার বাংলায় ইতোমধ্যে মুভি বানানো হয়েছে; নাম ছিল “সন্ন্যাসী রাজা”; অভিনয় করেছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। আরেকটি মুভি মুক্তি পাবে পরের মাসের ১২ তারিখ; নাম “এক যে ছিলো রাজা”। নাম ভূমিকায় অভিনয় করবেন “জাতিস্মর” খ্যাত যীশু সেনগুপ্ত;আমাদের দেশের অভিনেত্রী জয়া আহসানও আছেন মুভিটিতে।
আমাদের দেশের কাহিনী নিয়ে বাইরে মুভি হয়ে যাইতেছে, আর আমরা............... 
 

No comments:

Post a Comment